আনন্দময়ীর আগমন – ভক্তি ও শক্তি
শরতের শোভা মন্ডিত শুভ্র মেঘের ভেলা আর শিউলি ফুলের মিষ্টি সুরভি যেন জানিয়ে দিচ্ছে মা দুর্গার আগমনী বার্তা। আনন্দময়ীকে বরণ করার জন্য আগমনী গানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হচ্ছে “শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও, জননী এসেছে দ্বারে”। মা আসছেন বর্ষপরে আমাদের মাঝে অপার কৃপা ও দশ হাতে দশ দিক থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে। তাই পূজার শুভ লগ্নে আমরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করি-রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশে শরতের শোভা মন্ডিত দেহি, দ্বিষো জহি।” অর্থাৎ রূপ দাও, জয় দাও, যশ দাও এবং শত্রু নাশ কর। কল্যাণময়ী দেবী আমাদের কল্যাণে অসুর বধ করেছেন, আবার পিতৃ সান্নিধ্যে এসে বাৎসল্য রসে সিক্ত করেছেন ধরণী। পূজার সময় মা যেন সমস্ত স্বর্গীয় ঐশ্বর্যকে টেনে আনেন মর্ত্যরে মাটিতে। ভক্তরা আবেগে আপ্লুত হয়ে মায়ের অতুল রাতুল চরণে পুষ্পাঞ্জলি ও কল্যাণ মূর্তি দর্শনে আকুল হয়ে উঠেন। বিশাল এ মহতি আয়োজনকে কেন্দ্র করে কর্ম চঞ্চল ও কর্মবীর তরুণরা দীপ্ত মনোবল নিয়ে ঐতিহ্য মন্ডিত পূজা উৎসবকে নানা সাজ-সম্ভারে আকর্ষনীয় করে তোলেন।
শারদীয় দুর্গা পূজা মানব জাতির শাশ্বত ঐতিহ্যের প্রতীক। বাঙ্গালীর চিন্তা চেতনায় দুর্গা পূজা এখন হয়ে উঠেছে মহতি উৎসবে। তবে কখনো এ উৎসবকে ঘিরে আবর্তিত হয় আনন্দ বেদনার সুর। অশুভ শক্তির আবির্ভাবে কোথাও কোথাও পূজা মন্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটে থাকে। এ এক অশুভ অপয়া ইংঙ্গিত। মায়ের শরনাগত হয়ে অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির কামনা করছে। মহাশক্তিধর বিচিত্র রূপিনী মায়ের কাছে আসুরিক শক্তির সব সময় পরাজয় ঘটে। ভক্তকে ত্রাণ করতে, বরাভয় দান করতে বঙ্গজননী বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী যান কখনো নৌকা, গজে বা দোলায় ধরাধামে আগমন করেন। এবার তিনি নৌকায় শুভ আগমন ও ঘোটকে গমন করবেন।
আগেরকার দিনে রাজসিক ভাবে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হত। রাজ-রাজারা, জমিদারগণ ও ধণাঢ্য ব্যক্তিরা নিজ বাড়ীতে আড়ম্বর ভাবে পূজার আয়োজন করত। এত ব্যয় বহুল পূজা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তদানীন্তন সময় অনেক রাজা-জমিদারগণ নিজ আভিজাত্য, অহংকার ও নামের বাহাদুরী প্রকাশে প্রতিযোগিতা মূলক দুর্গা পূজা দিতেন। এসব জাক-জমক পূজার বিশাল আয়োজন থাকলেও তাঁদের মনে মায়ের প্রতি কোন ভক্তি, শ্রদ্ধা ছিল না। দাম্ভিক রাজাদের পুজা, ফলে তামসিকতায় পর্যবসিত হয়ে যেত। এ সম্পর্কে তৎকালীন কালের একটি গল্পের অবতারনা করা দরকার।
রাজবাড়ীর কাছাকাছি অভাবগ্রস্ত এক ব্যক্তি খুব দুর্গা মায়ের ভক্ত ছিলেন এবং দেবীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অবিচল ভক্তি ছিল। রাজবাড়ীর পূজোয় অংশগ্রহণের তার কোন সুযোগ ছিল না। সমাজের নীচু, স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য ও গরীব দুঃখীরা ঐ রাজার চোখে অবজ্ঞার পাত্র ছিল। ছোট লোকদের কারণে ফুল বাবুদের গায়ে কাদা লাগলে হয়ত অশুচি হবে পূজার সব আয়োজন। এ কথা ভেবে হত দরিদ্র লোকটি মনের দুঃখে নিজ কুটিরে মায়ের মঙ্গল ঘট স্থাপন করে পূজার দিন থেকে যথারীতি পূজা অর্চনা করতে থাকেন। পূজার মহানবমী তিথিতে তিনি মনস্থ করেন মাকে ভোগ দিবেন। কিন্তু অর্থাভাবে সে ভোগের জিনিসপত্র কিনতে পারলেন না। অবশেষে অশ্রু সজল নয়ণে সে শুধু মাত্র শাকান্ন কলাপাতে মায়ের নামে ভোগ নিবেদন করেন এবং ভক্তি ভরে মাকে আকুল আহ্বান করতে থাকেন।
ওদিকে রাজবাড়ীর পূজা মন্ডপে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে স্বর্ণ থালায় দেবীকে রাজভোগ নিবেদন করা হয়। কিন্তু আভিজাত্যের অহংকারে লোক দেখানো লোভনীয় রাজভোগ হাজার হাজার সন্তানকে ভুখা রেখে মা কি ভাবে গ্রহণ করবেন? ঐ দিনেই বিকালে রাজবাড়ীতে বিরাট হৈ-চৈ পড়ে যায়-রাজবাড়ীর দুর্গা প্রতিমার মুখে শাক-ভাত লেগে আছে। রাজবাড়ীতে দেবীর মুখে কি ভাবে শাক-ভাত এলো? এ সংবাদ রাজার কানে গেলে পুরোহিত মহাশয় তিনিও অবাক হয়ে দেখেন, মা দুর্গা রাজার মহামূল্যবান রাজভোগ ছেড়ে শাকান্ন ভোগ গ্রহণ করেছেন। পরে জানা যায়, রাজবাড়ীর পার্শ্বের কুটিরে নিতান্ত এক গরীব লোক দুপুরে মঙ্গল ঘটে শাকান্ন নিবেদন করেছেন। এ থেকে রাজা শিক্ষা পেল অর্থ, সামর্থ থাকলে এবং মনে ভক্তি না থাকলে, মা কারো সে পূজা গ্রহণ করেন না।
পূজার দিন গুলো সত্যি এক আনন্দ উৎসবের মিলন মেলা। আমাদের এ পূজা মানব কল্যানের পূজা বিশ্ব কল্যাণের পূজা। শারদীয় দূর্গা পূজা সবার মধ্যে প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন ও ভক্তি ভাব প্রসারিত করার শিক্ষা দেয়। বঙ্গ জননীর আগমনে সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ, শান্তি এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি পূজা মন্ডপ। পূজা ও বিজয়ার আনন্দ থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। আমাদের হৃত ভক্তি হৃত শক্তি আবার ফিরে আসুক এ কামনা করি মনে প্রাণে।
রনজিৎ কুমার রায়