কুড়িগ্রামের উন্নয়ন বৈষম্য দূর হবে কবে?

কুড়িগ্রামের উন্নয়ন বৈষম্য দূর হবে কবে?

By Ulipur.com on November 8, 2017 কুড়িগ্রাম

মো. মাসুদ রানা:
বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপির হার বেড়েছে কিন্তু কুড়িগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান এখনো বাড়েনি। কোনো একটি অঞ্চলের মানুষকে অভুক্ত, দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে যদি শত শত প্রকল্পের উদ্বোধন ও বাস্তবায়ন করা হয় তবে আমি সেটাকে উন্নয়ন বলে মনে করি না। আমরা যেখানে খাওয়ার জন্য ভাত পাই না সেখানে কার গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখাটা দুঃস্বপ্ন।

কুড়িগ্রাম জেলার উন্নয়নের পথে এই জেলার নদ-নদীগুলো বর্তমানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট জেলাটির ভিতর দিয়ে প্রায় ২০টি নদী বয়ে গেছে। প্রতিবছর অনেক বড় বড় বন্যা এসে এই জেলার মানুষের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে চলে যায়। সারা বছর ভালোভাবে চলার জন্য যে ফসলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় তাদের, সেই ফসল বন্যায় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে খেয়ে না খেয়ে তাদের জীবনযাপন করতে হয়। বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ার পরও যেটুকু ফসল রয়ে যায়, তার উপযুক্ত মূল্য কৃষকরা পায় না। ফলস্বরূপ, তাদের ফসল উত্পাদনে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়। বন্যার সঙ্গে যোগ দেয় নদী ভাঙন, হারাতে হয় তাদের বাস্তুভিটা ও আবাদি জমি। সবকিছু হারিয়ে বসবাস করতে হয় ঠিক উদ্বাস্তুদের মতো।

কুড়িগ্রামে কোনো বড় ধরনের শিল্প-কারখানা নেই। আর শিল্প-কারখানা একটি এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থান অনেক উপরে নিয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জ কলকারখানা-শিল্পসমৃদ্ধ এ বলেই দেশের সবচেয়ে কম দরিদ্র মানুষ সেখানে বসবাস করে।

শিক্ষাক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম জেলা অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ (সূত্র : বিবিএস জরিপ -২০১৭) কিন্তু কুড়িগ্রামে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অধিকাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর হওয়াতে এখানে সবচেয়ে বেশি বাল্য বিবাহ সংঘটিত হয়। ইউনিসেফ-এর মতে (২০১৪) এই সংখ্যা বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ হলেও কুড়িগ্রামে ৭৮ শতাংশ। আর এই শিক্ষার হার কম হওয়াটাও কুড়িগ্রামের মানুষের দরিদ্রতার অন্যতম কারণ।

তবে আশার কথা হলো যে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে এসে বেশ কয়েকটি উন্নয়নমুখী কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে কলকারখানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করা, কুড়িগ্রামে সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা, কৃষিতে উন্নয়নের জন্য নদীতে ড্রেজিং করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ির সঙ্গে লালমনিরহাটের যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য দ্বিতীয় ধরলা সেতু নির্মাণসহ (সেতুটির কাজ শেষের পথে) সর্বমোট ১৬টি প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছেন যা নিঃসন্দেহে কুড়িগ্রাম জেলার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এসব প্রকল্প অতিদ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি যদি এর সঙ্গে আরো বেশকিছু উন্নয়নমূলক কার্যক্রম হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করা হয় তবে হয়ত-বা কুড়িগ্রাম থেকে মঙ্গা চিরতরে হারিয়ে যাবে। কার্যক্রমগুলো হলো :

এক. বর্তমান সরকার চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে দ্বিতীয় তিস্তা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন এবং বর্তমানে এর কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। এই সেতুর মূল নকশায় যদি রেলপথ যুক্ত করা হয় এবং তা যদি প্রস্তাবিত ফুলছড়ি-দেওয়ানগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেলে যোগ করা হয় তবে চিলমারী থেকে ঢাকার দূরুত্ব প্রায় ২০০ কি.মি. কমে যাবে। এর ফলে কুড়িগ্রামের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং এ জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। দুই. চিলমারী নৌ-বন্দরের কাজ দ্রুত সম্পাদন করা এবং এটিকে পুনরায় চালু করা। তিন. কুড়িগ্রামে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না করে সরকারি উদ্যোগে স্থাপন করা। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়িগ্রামের গরিব মেধাবী ছাত্ররা টাকার অভাবে পড়তে পারবে না। যেহেতু কুড়িগ্রাম জেলাটি কৃষিপ্রধান জেলা, তাই সেখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করাটাই সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। তাহলে জেলার কৃষি উন্নয়ন খুব দ্রুত ত্বরান্বিত হবে। চার. পর্যটকদের জন্য নদী কেন্দ্রিক দর্শনীয় স্থান গড়ে তোলা। পাঁচ. কুড়িগ্রামে প্রায় চার শতাধিক চর রয়েছে। এসবের উন্নয়ন ব্যতীত কুড়িগ্রামের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই চরের উন্নয়নে বিশেষ বাজেট প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ছয়. দীর্ঘ ৬৮ বছরের ছিটমহল নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ সকল নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা জানি আপনি কুড়িগ্রামের উন্নয়নে কতটা আন্তরিক। তাই আপনার ওপর আমরা বিশ্বাস রেখেছি। আশা করি আপনি কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও এই জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন। সেই সুন্দর হাসিটা হাসার অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক : শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সুত্র:ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *