সুচরিতা

সুচরিতা

সাদিক ইসলাম:
তখন ছিল বর্ষাকাল আর কয়েকদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি শেষে সবে আকাশ শ্রান্ত হয়েছে; তবে মেঘের ঘন কালো মুখ তখনও গম্ভীর; কখন যে আবার শালবন, ঘন বাঁশঝাড় আর চারদিক ঘন বন ঘেরা এই রত্নাই নদীর তীরের বিশ পঁচিশ ঘরঅলা গাছপূর্ণ গ্রামকে বৃষ্টি এসে বিশ্বচরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন করবে তা কে বা জানে। রাস্তা বলতে যেন দুর্গম বনের ভিতর একটা সর্পিল অবাঞ্ছিত ঘাসহীন কাদামাখা অনাহূত মাটির প্রকাশমাত্র। সেই পথ দিয়ে সরকারদের ঘোড়াগাড়িটি ঘোড়ার পিঠে সপাৎসপাৎ চাবুক খেতে খেতে চলছিল; ঘোড়ার গাড়ির শব্দে পৃথিবীর এই নির্জন প্রান্তে দু’একজন উৎসুক নর-নারী আর রাস্তার মলিন মুখ ছেলেমেয়েরা লেবু গাছ, কামিনী গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সেই রাজকীয় গাড়ি দেখে বুঝলো আজ চৌধুরীদের বাড়িতে বড় কিছু একটা ঘটবে। গাড়ির ভিতর থেকে একটা বিরক্ত কণ্ঠ বার বার কোচোয়ানকে ধমকের সুরে বলছিল এই সুরেস তোর কি পথ একদিনে শেষ হবে না; তুই কতদিন গাড়ি চালাস! উত্তরে সুরেসও কিছুটা বিরক্তি ঢেলে বলে কী করবো ছোট সাহেব রাস্তাতো আপনি দেখছেন যেমন সরু তেমন পিচ্ছিল আর এত খালখন্দ আমি পুরো মহকুমার কোন রাস্তায় দেখিনি মনে হয় এই গ্রামের জমিদার মশায় হাড়কিপটা। রশিদ সাহেব ভিতর থেকে কোচওয়ানের সঙ্গে একমত হয়ে বললো নিতান্তই ঠিক বলেছিস।

শুধু পাত্র নয়ন বলল মামা রাস্তাতো কারও একার না একজনকে এর জন্য দোষ দিয়ে লাভ নেই। রশিদ সাহেব নয়নকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বললেন এখনও পাত্রী দেখেনি ঘরবাড়ি কিছুই দেখেনি বোকাটা পাত্রীর বাবার জন্য উতলা হয়ে উঠছে; তোর এই বোকামির জন্যই তো শত শত মেয়ে দেখেও তোর বিয়ে হলো না উত্তরে নিষ্প্রভ নয়ন বলল মামা তোমারই তো কোন সমন্ধ পছন্দ হচ্ছে না পাঁচ বছর ধরে। কথাটা শুনে তার মামা শক্ত গলায় বলল শোন শত মাইলের মধ্যে একটা সমন্ধ দেখাতে পারবি সরকারদের বিত্ত, মান, সম্পদ, প্রতিপত্তির সঙ্গে যায়? শুধু সুন্দর একটা মুখ হলেই হয়? হিসাব নিকাশ থাকতে হয়। নয়ন মাথা নিচু করে থাকল কোন উত্তর দিতে পারলো না ; সে এই হিসাব নিকাশ যে কী তা বুঝে না।

ওদিকে চৌধুরীদের বাড়িতে বিরাট সাজসাজ আর সাড়া পড়ে গেছে; রাঁধুনি বাড়ির দক্ষিণ দিকে বেশ কিছু গাছ কেটে, জঙ্গল সাফ করে তবে চুলা বানিয়ে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে বড় বড় হাঁড়ি বসানোর ব্যবস্থা করেছে। খাসি, গরু, বড়মাছ, কত পদের ছোট মাছ আর নানান রান্না হচ্ছে তার হিসেব নেই; দই মিষ্টি তো একদিন আগেই পাশের মহকুমার ঘোষদের দোকান থেকে ভোলা গিয়ে নিয়ে এসেছে। শিকদার চৌধুরী এই গ্রামের বড় জমিদার আজ তার মেয়েকে দেখতে আসা হবে। তাই তার ভাইবোন, শ্যালক, শ্যালিকা, আর পাড়া-প্রতিবেশী উপচে পড়েছে এই বাড়িতে; ছেলে পক্ষের যেন বিন্দুমাত্র ঘাটতি না হয় সেবা, যত্ন, আপ্যায়নে তাতে সবাই তটস্থ। চৌধুরী সাহেব আজ কী কারণে তার দামী হুকোটা বার বার টেনে হাপরের মতো গরম করে তুলেছেন।

শিকদার চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে সুচরিতা; ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ালেখা করবার পরে বাবা তার মায়ের অনুযোগ শুনতে শুনতে মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছেন; গ্রামের সে প্রথম মেয়ে যে স্কুলে গিয়েছিল তাও আবার চৌধুরীর মেয়ে বলে আর মেয়েটা বইপাগল আর বাবার আবদারের ধন তাই বাবাকে যখন নাছোড়বান্দার মতো ধরল তখন বাবা প-িতমশাইয়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে স্কুল রুমে পর্দা টানিয়ে সুচরিতা আর আহমেদ সাহেবের মেয়ে শোভা যে সুচরিতার দুই বছরের ছোট তাদের পাঠদানের বন্দোবস্ত হলো। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হলো না; তারা ভর্তি হলো সরাসরি ক্লাস সিক্সে আর ক্লাস এইটে উঠতেই সুচরিতার মা তার বাবাকে বলল এত্তো বয়সের মেয়ে যার বিয়ে করে সংসার করার বয়স পার হয়ে যাচ্ছে সে যাবে স্কুলে মেয়েদের বেশি পড়ালেখাটা বালাই; বলে রাখলাম এটা ভবিষ্যতে অমঙ্গল বয়ে আনবে। আসলে সুচরিতার মায়ের মেয়ের স্কুলে না যাবার পিছনে আরকটা কারণ সুচরিতার মুখশ্রী; মেয়েটা একটু বাড়াবাড়ি ধরনের সুন্দর। আর তার উপর ভালমন্দ বোঝার কোন বয়স তখন ছিল না। সুচরিতার মন খুব বেশি কোমল ছিল, কোনোদিন কোন অন্নহীন বা বস্ত্রহীন তাদের বাড়ি থেকে না খেয়ে বা দু’চার পয়সা না নিয়ে ফেরত যায়নি। আর গ্রামের কে কোথায় খেয়ে না খেয়ে থাকে; কে মাথার ওপর ছাদের অভাবে মসজিদ, মন্দিরে রাত কাটায়; বাবাকে আবদার ধরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিত। তাই এই খামখেয়ালি মেয়েকে নিয়ে মায়ের চিন্তার অন্ত ছিল না। এসব কারণে তার মা যখন একেবারেই একগুঁয়ে সুচরিতার বাবা সুচরিতার পক্ষ নিলে তার মার প্রবল আপত্তিতে সুচরিতা ঐ দু’বছরই পড়ালেখার সুযোগ পেল তারপর আবার গৃহবন্দী সাথী বলতে একজন শোভা; যার সঙ্গে সারাদিন কাটে। আজ সেই শোভাই সুচরিতার ঘরের দরজা বন্ধ করে এই প্রথম সুচরিতাকে সাজগোজ করাচ্ছে; মাঝখানে এসে ছোটখালা একটু শাড়িটাড়ি, আঁচল ঠিকঠাক করে দিয়ে গেছে। হাতে মেহেদি দেয়া হয়েছিল আগের দিন সঙ্গে পায়ে আলতা। সুচরিতার বড় বড় মায়া ভরা চোখ, একজোড়া টানা বঙ্কিম ভ্রƒ, আঁকানো ঠোঁট আর একটু হাসলেই যে সরল মধু ছড়িয়ে পড়ত সারা মুখে তাতে কেউ বিমোহিত না হয়ে পাড়ত না। ও কখনও সাজতো না কিন্তু ওর মুখটা আর ঘনকালো চুলে ওকে সাজানো গোছানো কোন চিত্রশিল্পীর দরদ দিয়ে আঁকা একটি অনিন্দ্য সুন্দর মূর্তি মনে হতো। শোভা মনে হয় এই প্রথম সুচরিতার ঠোটে লাল রঙ মাখলো, চোখে কাজল, লিপিস্টিক, মুখে মিহি পাউডার। শোভা সুচরিতাকে সাজিয়ে নিজেই অবাক; ওমা সুচি তোকে সাজলে যদি এতো সুন্দর দেখায় তবে ছেলে তো দেখতে আসলে এই বাড়ি ছেড়েই যাবে না; হেসে শোভা আয়নাটা সুচরিতার মুখের সামনে ধরতে ধরতে বলল। সুচরিতা নিজেকে দেখেই চমকে উঠল। প্রতিটা মানুষ নিজেকে ভালোবাসে; কুৎসিত মানুষের আত্ম প্রেম আছে; পশুদেরও আছে; বানরেরও আছে। সুচরিতা খুব বেশি আয়নায় নিজেকে দেখত না। দেখলেও অতো মনোযোগ দিয়ে নয়; আজ যখন সাজানোগোছানো তার নিজের সুন্দর মুখটা দেখলো ওর মনে হলো অন্য কোন একজন আর নিজেকেই অপরিচিত মনে হলো নিজের কাছে; মনে হলো এমন অনিন্দ্য সুন্দর মেয়ে সে পৃথিবীতে এই প্রথম দেখল। নিজের মুখ থেকে নিজের চোখ সরাতে পারল না। শোভা হাসতে হাসতে বলল নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে গেলি? প্রেম শব্দটা সুচরিতার কাছে অন্য কোন অর্থ বহন করল না। বুঝলো বরের আগমন উপলক্ষে শোভা সুন্দরী সখীর সঙ্গে মজা করছে। তাতো করবেই কিন্তু একটা ছেলে তাকে দেখতে আসছে এর জন্য সুচরিতার মনে বিন্দু পরিমাণ নতুন কিছু অনুভূত হচ্ছে না বরং তার কাছে এই একটা দিনকে অন্য সব দিনের চেয়ে কেমন বিরক্তিকর মনে হচ্ছে কারণ সুচরিতার নিয়মের এতো বালাই অপছন্দ। সুচরিতা সাধারণ হয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে ও যে জমিদারের একমাত্র মেয়ে ও যে অসাধারণ সুন্দরি সবার কাছে ওর কদর কিন্তু ওর নিজের ভিতরে এক সহজসরল মন বাস করে অসাধারণ ব্যাপারটা ওর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথৈ, গভীর আর অপরূপ জলরাশি নিয়ে যেমন শরতের নদী আপন মহিমায় নীরব তেমনি শব্দের চেয়ে সুচরিতাও নীরবতা দিয়ে সব অনুভূত করে। তাই সেই অপরূপ শরতের মতো একটা মোহনিয় ছায়া ওর মুখ জুরে ভেসে বেড়ায়। আসলে তার সেই বয়সটি আসেনি যখন প্রেম, ভালবাসা, আবেগ ব্যাপারগুলো একটা মনকে নাড়া দিবে।

এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল তিনটে বেজে গেছে তবু পাত্রসহ সরকারদের আগমন এখনো ঘটেনি। মেয়ের বাবা হলে, বিয়ের সময় সামান্য ব্যাপারকেও খুব ভারি মনে হয়; চৌধুরী সাহেব সবাইকে আশ্বস্ত করলেও নিজেই ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি আর অস্থির বোধ করতে লাগলেন যতটা না নিজের জন্য আরও বেশি নিজের কন্যার জন্য; কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির দারোয়ান কলিম দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হুজুর বড় চলে এসেছে গাড়ি এখন শ্মশানঘাটের কাছে। চৌধুরী সাহেব তার শ্যালক কবিরকে ডেকে বললেন চল তাড়াতাড়ি আর তোরা কলিম মিয়া ভিতরে সবাইকে বলে দে পাত্র উপস্থিত। চৌধুরী বাড়ির বড় গেটের কাছে যেতেই দেখলেন অনতিদূরে ঘোড়ার গাড়ি।

ছেলের মামা রশিদ আহমেদ অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। এসেই তিনি মেয়ের বাবা, শ্যালক আত্মীয় থেকে ঘরদোর, আসবাব, ফুলের টব পর্যন্ত তার তীক্ষè চোখ দিয়ে যেমন দেখলেন মনে মনেও সব মাপজোক করতে লাগলেন; কিন্তু কোথাও কোন খুঁত পেলেন না। কিন্তু চৌধুরী সাহেবকে তো তিনি ছাড়বার লোক নন আর হাজার হলেও পাত্রপক্ষ তাই, খুব তিরস্কার করেই বললেন ‘শিকদার সাহেব এটা কি কোন রাস্তা হলো? মনে হচ্ছে আপনার বাড়ির বিশ ক্রোশ রাস্তায় আসতে শরীরে যে ব্যাঘাত গেল আগামী এক সপ্তাহ গায়ের ব্যথা যাবে না।’ শিকদার সাহেব একটু দমে গেলেন কিন্তু উত্তরে বললেন কী করবো রশিদ সাহেব প্রতিবছরই তো এই রাস্তা বাঁধি কিন্তু দেখলেন না পথে রতœাই নদী সেটাই ভাসিয়ে নিয়ে যায় আর এখনতো বর্ষাকাল তাই ভোগান্তিটা আপনাদের একটু বেশি হলো; তা নিয়ে অবশ্য আমারো চিন্তা হচ্ছিল। রশিদ সাহেব শিকদার সাহেবকে থামিয়ে বললেন আমি কিন্তু পুরো মহকুমায় এতো বাজে রাস্তা আর একটা দেখিনি আর এতো কাদা। মনে হয় প্রকৃতির অনিয়মের দায়ভারও পাত্রী পক্ষের বিরুদ্ধে যায়। নয়নের তার মামার পাত্রীর বাবাকে এমনভাবে জেরা করা ভালো লাগলো না কিন্তু সে পাত্র আর তার বিয়ে যতটা না তার হাতে তার চাইতে আরও বেশি বাবা মা, আর মূলত এই অতি বিচক্ষণ মামার হাতে। শিকদার সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে বললেন চলুন আপনারা ক্লান্ত শ্রান্ত আর দুপুরের খাবার সময় সেই কখন পার হয়ে গেছে; চলুন খাওয়া সেরে নেয়া যাক আগে।

দুপুরে খাবারদাবার শেষ করে শুরু হলো আসল কাজ- যার জন্য এতো আয়োজন সেই পাত্রী দেখবার পালা। কয়েকদিন ধরে এই আয়োজন নিয়ে সুচরিতার কম ঝামেলা যায়নি তবুও কোনো ধরনের আপত্তি সে করেনি। এটাই বাংলাদেশের নিয়ম ছেলেরা ইচ্ছামাফিক পাত্রী দেখে বেড়াবে আর মেয়েরা দোকানের সামগ্রীর মতো নিজেদের প্রদর্শন করবে- মেয়ে পক্ষ থেকে সবসময় অশনি আশঙ্কা থাকবে আমার মেয়েটাকে কুরবানির গরুর মতো ভালমন্দ দেখবে ইচ্ছে হলে ক্রেতা কিনবে না হলে আরেকটা দেখবে কিন্তু একটা পার্থক্য আছে কুরবানির গরু ক্রেতা দাম দিয়ে কিনে আর কুরবানির পাত্রী দাম দিয়ে বিক্রি করতে হয়। রশিদ সাহেব পাকা জহুরীর মতো সুচরিতাকে দেখছেন- পাত্রর চেয়ে তারই দেখার দাবিটা বেশি – এ দেশে ছেলেরা পাত্রীকে বিয়ে করে না বিয়ে করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মতামতকে। নয়নের মামার খুঁত সন্ধানী চোখ দেখে মনে হলো তিনি খুবই হতাশ কারণ এ মেয়ের কোনো খুঁত খুঁজে পাওয়া কঠিন কিন্তু পাত্র পক্ষ পাত্রী পক্ষের কোনো ত্রুটি খুঁজে না পাওয়া পরাজয়ের মতো। সুচরিতার সুশ্রী চেহারা, মিষ্টি ভাষা, অমায়িক ব্যবহার, ন¤্রতা আর সব কিছু মেনে নেবার ইচ্ছা রশিদ সাহেবের জন্য অস্বস্তিকর রকমের মনে হলো। নয়ন বিমুগ্ধ চোখে সুচরিতার অবগুণ্ঠিত মুখের মধুর কথা আর তার ব্যবহারের বিস্ময়কর রকমের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ মনে আশ্চর্য হলো- এই সভ্যতাবিবর্জিত, বিচ্ছিন্ন পল্লীতেও এমন সুরুচিসম্পন্ন মেয়ে থাকতে পারে তা তার বিশ্বাসই হলোনা। নয়নের মামা নয়নের এই নির্লজ্জ মুগ্ধতায় আরো অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে নয়নকে দেখে সুচরিতার সারা শরীরে একটা নীরব কিন্তু প্রবল রোমাঞ্চকর অনুভূতি বয়ে গেল সুচরিতা তখনও জানে না এটা কী। গ্রামের মলিন মুখের ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে সুচরিতার মনে এক ধরনের মায়া, মমতার জন্ম নিতো হয়ত: তা ভালবাসা কিন্তু নরনারীর ভালবাসা কী তা সে জানত না। তার মনে আজ যে ভাবের উদয় হলো তার ব্যাখ্যাও সে জানেনা; সে ভাবের উদ্রেক হতে কিছু একটা লাগে সেই কিছু একটা কী সুচরিতার মন তার সন্ধান পেল কি পেল না তাও বোঝা মুশকিল। যখন আসন্ন বিপদ টের পেলেন রশিদ সাহেব খুব দ্রুত মনে মনে কিছু একটা বের করবার চেষ্টা করলেন। সুচরিতার কথা, তার আত্মবিশ্বাস, তার কোমল অথচ যথার্থ উত্তর রশিদ সাহেবের মনে একটা সন্দেহের জবাব দিল। তাই তিনি মেয়েকে বললেন মা তুমি এখন যাও। নয়নকেও যেতে বললেন তিনি চৌধুরী সাহেবকে সরাসরি বললেন আপনাদের মেয়েতো ক্লাস এইট পর্যন্ত ছেলেদের সঙ্গে এক স্কুলে পড়ালেখা করেছে আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো মেয়ের জন্ম কত সালে? শিকদার সাহেব অবাক হয়ে বললেন সত্য মিথ্যার কী আছে আমার সুচির জন্ম ১৯০১ সালে। রশিদ সাহেব আঁতকে উঠলেন বললেন একি শুনলাম আমাদের ৩০ বছরের নয়নের সঙ্গে বিয়ে হবে ১৭ বছরের এক আইবুড়ো মেয়ের সাথে? না না চৌধুরী সাহেব আপনারা আমাদের সঙ্গে যা করলেন তার পুরোটাই প্রতারণা!

রশিদ সাহেব আর কোন সময় নিলেন না চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে ঝড়ের বেগে নয়নের হাত ধরে বললেন চল এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। নয়ন তখন চৌধুরী সাহেবের শ্যালকের সঙ্গে আলাপে ছিল কিন্তু তার মনোযোগ যত না কথার প্রতি ছিল ঘরে দেখে আসা মেয়েটার জন্য ভিতরে ভিতরে জোয়ারের জলের মতন সবকূল ছাপিয়ে এক অজানা অনুভূতি তার মনের সবটুকু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল; তাই কথা জ্বি, হুম, ঠিক, আচ্ছা এই উত্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর বারবার ভাবছিল ঐ আধখানি চন্দ্রমুখ যদি আবার দেখতে পেত আর মধুর সেই মুখের ভাষা যদি আবার শুনতে পেত শুধু একবার। কিন্তু তার মামা উগ্র এক ঝড় হয়ে এসে সজোরে তার হাত ধরে যেভাবে গৃহ ত্যাগ করলেন তাতে না ছিল সৌজন্যতা না ছিল ভব্যতা; আর নয়নও তার মামার এই অনাকাঙ্খিত আচরণে পুরো অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল নয়নের মনে হলো এই অজানা, অপাঙক্তেয় গ্রামে সে তার জীবনের সবচেয়ে পরিচিত আপন কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছিল। এই ছোট্ট একটা গ্রামের তুলনায় বাকি প্রকা- পৃথিবীটাকে তার একেবারেই তুচ্ছ মনে হলো। এখানে তো তার জরুরী কোন কাজ নেই; জীবনে একবারই আসা অথচ এর তুলনায় বাইরের পুরো পৃথিবী তার কাছে নিতান্তই ভীষণ গুরুত্বহীন মনে হলো। কিন্তু গাড়ির যে আরেকজন বয়স্ক ব্যক্তি তার গম্ভীর ক্ষিপ্ত চেহারা আর সাদামুখটার লাল বর্ণ আর সব বলে দিচ্ছিল। পাশে বসে থাকা নয়নকে তার কিছুই মনে হলো না বরং গাড়ির কোচওয়ানের উদ্দেশে সে তার সমস্ত রাগের ডালা উগরে দিচ্ছিলেন। নয়নের তার মামার এই ব্যবহার সত্যি বাড়াবাড়ি রকমের মনে হচ্ছিলো। কিন্তু তবু সে চুপচাপ বসে ছিল স্বভাববশত। মামা সচরাচর যা করেন; পাত্রী দেখার পর পাত্রীর গুষ্টি উদ্ধার ; তাই চলছিল। তার সমস্ত রাগ শিকদারের ওপর অনল ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু যখন সুচরিতার প্রসঙ্গ উঠলো আর সুচরিতা যে বেয়াদব, বড়দের সম্মান করতে জানে না, স্পষ্টভাষী, আর মেয়েদের এমনটা হতে নেই; মেয়েদের পাত্রপক্ষের প্রশ্নেও যে চুপ থাকতে হয় এই ক্ষুদ্র জ্ঞানের চরম অভাব; আর তার উপর আইবুড়ো এক মেয়ের এমন নির্লজ্জ সাহস তাতে নয়নের মামা ক্ষুদ্ধ, স্তম্ভিত। তাই যখন আর দেখা সব মেয়ের চেয়ে এই মেয়ে নিকৃষ্ট তাই যখন নয়নের মামা রায় দিয়ে দিলেন নয়ন আর চুপ থাকতে পারল না। গ্রামবাংলার এই এক বিচিত্র আমূল ধারণা পাত্রীরা হচ্ছে এক প্রকারের পুতুল আর পাত্র পক্ষ তাদের ইচ্ছেমাফিক নাচাবে সেই সুবিধা না হলে শ্বশুর পক্ষের শুধু মহিলা নয় পুরুষদের মধ্যেও রি রি ঢি ঢি পড়ে যাবে। এক্ষেত্রে পুরুষ মহিলায় কোন পার্থক্য নেই। তাই নয়নের মামা যখন আপাদমস্তক ভদ্র মেয়ে সুচরিতাকে বেয়াদব বলে ঘোষণা দিয়ে দিল আর তার বয়স নিয়ে কটাক্ষ করলেন তা নয়ন আর মানতে পারল না। নয়ন প্রতিবাদ করে বলল মামা তুমি কী কারণে শিকদার সাহেব আর তার মেয়ের প্রতি এতো রুষ্ট তা আমি বুঝতে পারছি না; আর ওরাতো আমাদের সঙ্গে খুব ভাল আচরণ করল; আমি যতো মেয়ে দেখেছি সবার চেয়ে এই মেয়েটিকে যোগ্য মনে হয়েছে। নয়নের মামা একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন নয়ন তোর নামটা তো নয়ন আর বয়স বাইশ তেইশও নেই তুই কি অন্ধ হয়ে গেছিস! এই ধারি একটা বাচাল মেয়ে যে ভদ্রতা জ্ঞানটুকুও জানে না তুই মামার বিপক্ষে গিয়ে তার পক্ষ নিচ্ছিস? নয়ন বলল মামা তুমিতো এই এলাকার সব মেয়ে আমাকে দেখালে আমার মতামত ছাড়াই সব বাতিল করে দিলে আর এইবার কোন কারণ ছাড়াই তুমি যে কেন এতো ক্ষেপে যাচ্ছ আমার বোধগম্য হচ্ছে না। মামা চেঁচিয়ে উঠলেন ‘কারণ ছাড়াই’ শিকদার ছলচাতুরী করে প্রায় বিশ বছরের একটা মেয়েকে আমাদের গছিয়ে দেবে এই চালাকি আমি সহজে হজম করব? দাঁড়াও আমার জ্যাঠার বাবা হাকিম ছিল আমি এর বিহিত করব। নয়নের এই তিরিশ বছর বয়সে আজ প্রথম মনে হলো আভিজাত্য শুধু মানুষের মহিমা বাড়ায় না মানুষকে ক্ষুদ্রও করে দেয়; এই যেমন তার মামা।

বাড়ি ফিরে রশিদ সাহেব কিভাবে একটা আইবুড়ো মেয়েকে দেখিয়ে তাদের অপমান করা হয়েছে তা নয়নের মাকে এমনভাবে বর্ণনা করলেন তাতে সুচরিতা তার চোখের সামনে এক কলঙ্কীনি হয়ে দাঁড়াল। নয়নের মা নয়নকে বুঝালো বাবা মন খারাপ করিস না; দেশে মেয়ের অভাব নেই আর তোর এই সুন্দর চেহারা; এমন ভাল স্বভাব এমন কোমল মন বিধাতা তোর জন্য সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটাই ঠিক করে রেখেছেন আর ছেলেদের তিরিশ বছরও যা বাইশ বছরও তা। দেখিস শীঘ্রই তুই যোগ্য একটা মেয়ে পাবি আমি বললাম, মায়ের কথা কখনো মিথ্যা হয় না। খুব তাড়াতাড়ি তোর আরেক সমন্ধের খোঁজ করব। নয়ন সব চুপ করে শুনছিল শুধু একটাই উত্তর দিলো, না আমি আর কোন মেয়ে দেখতে যাব না, বলেই সব উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। নয়নের মা ছেলের এমন ব্যবহার আগে কখনোই দেখেননি তিনি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

গ্রাম বাংলায় মেয়ে হোক ছেলে হোক কারও মুখে কোন কথা চাপা থাকে না; শুধু বলার সময় বলে শুধু তোকেই বললাম তুই কিন্তু আর কাউকে… এভাবে চলতে চলতে সুচরিতার বয়সের কথাটা সবার কানাকানি হয়ে গেল। নয়নের মামা তার বাবা, মাকে বলেছিলো আর তার মা যিনি একজন আপাদমস্তক নারী; বাঙালি নারী তাই সে তার ছোট বোনকে স্বাভাবিকভাবেই এই কথাটা না বলা পর্যন্ত শান্তি পেলেন না; সুচরিতার ছোটখালা ছিল অত্যন্ত চতুর স্বভাবের তাই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেই কথা আরো রং মেখে প্রচারিত হতে থাকল আর পাত্রী কঠোরভাবে দোষী সাব্যস্ত হলো। একদিন সুচরিতাদের গ্রামেও সেই কথা চাউর হয়ে গেল; সুচরিতা বয়স কী তা জানত না; তার বয়স যত বাবার আদরে সে সেই ছোট্ট খুকিই থেকে গেছে কিন্তু বাংলায় মেয়েরা যত না বয়সের কারণে বড় হয়ে ওঠে তার চেয়ে সমাজের ধাক্কা খেতে খেতে বেশি বড় হয়ে ওঠে। আর এই ধাক্কা বিয়ের বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। আর বাংলা সমাজে মেয়েদের এমন নির্মম ধাক্কা দেয়ায় এক নির্মম চাপা আনন্দ আছে আর এ আনন্দ ভাগাভাগির লোকেরও অভাব নেই। তাই সুচরিতা সেদিন- এ কথা শুনে প্রথম বুঝল সে মেয়েও না, নারীও না, পাত্রীও না বিয়ের বয়স পার হয়ে আসা পরিবারের এক বোঝা।

নয়ন তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বিমলকে সব ঘটনা খুলে বললো। বিমল বুঝল নয়নের মামা অতি হিসাবের জেরে নয়নের বিয়ে নিয়ে যা করছে তা ভাল কিছু তো নয়ই বরং অনিষ্ট ডেকে আনবার জন্য যথেষ্ট। আর নয়নের সুচরিতাকে এতো ভাল লেগেছে তা প- হতে দেয়া যায় না। তাই সে মনস্থিও করল তার বন্ধুকে সাহায্য করবে যত বাধাই আসুক না কেন।

ওদিকে নয়ন হঠাৎ যেন পালটে গেছে সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত ভাল; এই বর্ষার ঝমঝম বৃষ্টি; নানান ফুল কেয়া, কলাবতী, পদ্ম, পানাফুল, কলমী ফুল, কচুফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, আর কেন্দারের জন্য যে সারা বছরভর অপেক্ষা করতো তার এসব কিছুই ভাল লাগল না। তার খেয়ালি মন যে অপরূপ এক নারী মূর্তি খুঁজে পেয়েছিল; এক নিভৃত পল্লীর একবার দেখা এক মেয়ে তার সমস্ত বায়বীয় কল্পনাকে তাড়িয়ে মুহুর্মুহু তার হৃদয়ে এই প্রশ্ন করে যায় সে এখন কী করছে, কী ভাবছে, আর তার মামার এমন নির্লজ্জ আচরণে কতটা ব্যথিত? সুচরিতা যদি বিন্দুমাত্র ব্যথা পেয়ে থাকে এই আশঙ্কা নয়নকে ভিতরে ভিতরে জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে এমন করে দিচ্ছিল যেমনভাবে তেলহীন চলন্ত মেশিনের তপ্ত ইঞ্জিন দগ্ধ হয়। নারীর মাঝে এক বিপুল অপ্রকাশিত সৌন্দর্য আছে তা সবার কাছে প্রকাশিত হয় না সবাই বুঝেও না যার কাছে হয় সে সেই সৌন্দর্যের মায়ায় এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে সেখানে সবটুকু পুরুষ অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। নয়ন আশ্চর্য হয়ে ভাবে মাত্র কয়েক মুহূর্তের পরিচয় সুচরিতাকে তার কয়েকযুগের ভাললাগার বন্যার অতলতলে নিমজ্জিত করে দিয়েছে; তার ভাললাগার সবখানি সেই সুন্দর গ্রাস করে নিয়েছে।

ষোলো বছরের সুচরিতা যখন সতের বা বিশ বছরের আসামি হয়ে গেল তখন তার মানসিক অবস্থা কী তা জানবার প্রয়োজন আছে কিন্তু এই সুচরিতা অন্য ধাতুতে গড়া; তার ভিতরের শক্তি আর আত্মপ্রত্যয় আর নিজের তৈরি বিশ্বাস যা সে তার বাবার কাছে পেয়েছিল তা বাইরের ঝড়ে টালমাটাল হতে পারে কিন্তু সেই ঝড়ে সে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় না। নয়নের কথা; তার মামার আপত্তি আর অহঙ্কার তার মনকে নাড়া দেয় কিন্তু নুইয়ে দেয় না। সে তার এই ছোট বয়সে তেমন কোন ছেলের মুখোমুখি হয়নি হলেও চোখ দিয়ে তাদের দেখেছে তার মনে তারা বিন্দুমাত্র রেখাপাত করেনি। কিন্তু নয়ন যাকে বাসার সবাই তার মামার সঙ্গে সমানভাবে শত্রু করেছে সুচরিতা তাতে গা ভাসিয়ে দেয়নি। সে নয়নকে দেখেছিলো একবার, মাত্র একবার কিন্তু তাতেই সে নয়নের চোখের সব ভাষা পড়ে ফেলেছিল; নয়নের চোখের বিস্ময়, ভাললাগা, মুগ্ধতা, সরলতা সুচরিতার মনের ভিতরে এমনভাবে বিঁধে গেছে; সুচরিতা সেই মগ্ন চাহনির মাঝে এক জনমে হাজার দিনের বিশ্বাস আর নির্ভরতা দেখেছে; সে চোখে সে যে সত্য দেখেছে হাজার মিথ্যা এসেও তাতে অবিশ্বাস ধরাতে পারবে না। সময় বসে থাকে না। স্কুলে পড়তে গিয়ে মুখুজ্যের মেয়ে দীপা কয়েকদিন স্কুলে এসেছিল সেই এবার পূজায় সুচরিতাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছে। দীপা প্রায় সুচরিতার সমবয়সী সুচরিতার সঙ্গে ভাব জমতে সময় লাগেনি শোভা, সুচরিতা আসছে দুর্গা পূজায় যাবে দীপাদের বাসায় কিন্তু রতœা ই নদীর ওপারে তার বাসা তাই সুচরিতার মা’র ঘোরতর আপত্তি এই বয়সি মেয়েকে একা ছাড়তে কিন্তু ওর বাবা বলল যাক না বড়ভাইয়ের ছোট ছেলে ওদের সঙ্গে যাবে; মেয়েটাতো সবসময় এমন শখ করে না। শেষমেশ মা রাজি না হয়ে পারলেন না।

দুর্গাপূজা দীপাদের বাড়িতে এই অঞ্চলে সবচেয়ে ধুমধাম করে হয়; হাজার হাজার লোকের ভিড়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকেরা আসে। পূজোর পাশেই বসে মেলা, চড়ক খেলা, নাগরদোলা আর নানান খাবারের পশরা। দীপা বাবার অনুমতি নিয়ে সুচরিতা আর শোভাকে নিয়ে সেই মেলায় গেল ঘুরতে। ছেলেমেয়ে, বাচ্চা নানান বয়সের মানুষের ঢলে মুখরিত সে দিনটা। কিন্তু হঠাৎ একটা কিছু দুর্ঘটনা বোধহয় ঘটেছিল এক জায়গায় বেশ কিছু মানুষ গোল হয়ে উৎসুক হয়ে কিছু একটা ব্যাপার দেখছিল সবার কথা শুনে সুচরিতা বলল চল তো দেখি মনে হয় কোন খারাপ কিছু। শোভা বলল না সুচি বাবা রাগ করবেন কিন্তু সুচরিতার জোরাজুরিতে তারা যেতে বাধ্য হলো। যা দেখা গেল একটা ছেলে পড়ে আছে আর একজন তার পায়ে পানি দিয়ে, ওষুধ ঢেলে, কাপড় জড়িয়ে কিছু একটা করছে। কিন্তু সেই ত্রাণকর্তা পিছ ফিরে ছিল তাই ভালভাবে তাকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ দীপাকে দেখে বিমল এগিয়ে এসে বলল দীপা তুই? দীপা বলল তুই মেলায় এসেছিস আমাদের বাড়ি যাসনি কেন বল তো। দীপা আর বিমল দূর সম্পর্কের মাসতুতো ভাইবোন। বিমল উত্তর দিল যাচ্ছিলাম এই দেখ নাগরদোলা থেকে পড়ে একটা ছেলে পায়ে রক্তারক্তি তাকে নিয়ে আমার বন্ধু নয়ন যে কী শুরু করলো। নয়ন নামটা শুনে সুচরিতার সমস্ত শরীর বেয়ে এক প্রবল শিহরণ বয়ে গেল; এক মুহূর্তে বাজ পড়া মানুষের মতো নিথর হয়ে গেল ওর মনের ভিতরটা। দীপা বললো ঐ ছেলেটা তোর বন্ধু ওকে ডাক বাসায় নিয়ে চল। নয়নকে ডাকতেই মুখ না ফিরিয়ে বলল এই আরেকটু বাকি আসছি। নয়ন যখন ছেলেটার পা পরিপাটি করে বেঁধে নিশ্চিত হলো মুখ ফিরিয়েই সুচরিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল। চারদিকের এতো কোলাহলও ওর কাছে নীরব, নিঃশব্দ মনে হলো। তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নেও তাকে দেখলে ও এতো অবাক হতো না। তার এ কিছুদিনের রঙিন, মধুর, নেশার, চির সাধনা, বাসনা, কল্পনা তার সামনে অসামান্য রূপ, লাবণ্য, শুদ্ধতা আর সম্মোহনী মাধুর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিমল এসে যখন ঝাঁকি দিয়ে বলল কী হলো চল সে আবার বাস্তবে ফিরে আসল। দীপাদের বাড়িতে বিমল সব জানল, শোভা, দীপা সবাই। নয়ন সুচরিতাকে কাছে পেয়ে তার মামার ব্যবহারের জন্য মাফ চাইলা আর নিজের জন্যও ক্ষমা চাইল সুচরিতা বলল একজন উপরে আছেন সব কিছু ক্ষমা করার আর আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষের না আছে ক্ষমতা ভুল ধরার বা ক্ষমা করবার। দু’জন এক সময় বিদায় নিল কিন্তু এ বিদায় যতো দূরত্ব বাড়ায় তারচেয়ে বেশি কাছে আনে; তাই কারোই মনে হলো না তারা একে অপরের থেকে দূরে যাচ্ছে; তাদের আজ এই মহামিলন তা একবারের জন্য নয় সারাজীবনের বন্ধনের পণ হয়ে থাকল; কথায় নয় হৃদয়ে।

দেখতে দেখতে, এক বছর কেটে গেল। এদিকে নয়নের মামার মাছ শিকারের খুব নেশা ছিল। বিশেষ করে বর্ষা শেষে যখন শরতকাল আসতো; মাছগুলো পরিপুষ্ট আর নদী যখন স্তিমিত হতো তখন তাই এই বর্ষায়ও তিনি বেরিয়ে পড়লেন সাত আটটা নৌকা মাঝি, চাকরবাকর নিয়ে। কিন্তু যাত্রার পরের দিনই বিরাট আশঙ্কার খবর এলো হঠাৎ বানে রশিদ সাহেবের বেশিরভাগ নৌকা তলিয়ে গেছে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। খবর শুনে নয়নের মা মূর্ছা গেলেন। নয়নের বাবা যার কাছে পৃথিবী মানে হচ্ছে জমি, দলিল, আর গরীবের সম্পত্তি কম পয়সায় কেনা; তার কাছে এই সংবাদ বিশেষ গুরুত্ববহন করলোনা। তিনি শুধু খুব অশুভ সংবাদ বলে আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু নয়ন বসে থাকলোনা অসুস্থ মাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। সুধাময়ী নদী যেখানে এসে তার মামার নৌকা নিখোঁজ হয়েছিল শুনল বানে আরো দক্ষিণে ভেসে গেছে সব নৌকা। নদী পথে সারাদিন চলার পর নয়ন অবাক হয়ে দেখল রতœাই তীরে তাদের নৌকাগুলো সব উল্টেপাল্টে একাকার হয়ে আছে। তীরে নামতেই শুনল হ্যাঁ এখানে বানের তোড়ে নৌকাগুলো ভেসে এসেছিল আর নৌকার লোকগুলোকে এ গ্রামের এক জমিদার সাহেবের লোকজন উদ্ধার করে নিয়ে গেছে।

জমিদার সাহেবের বাসায় অনেক লোকের ভিড় নয়ন সেই ভিড় ঠেলে যেতেই অবাক বিস্ময়ে সুচরিতার বাবাকে দেখলো। বানে ভেসে সবাই আহত তাই তাদের চৌধুরীদের আসল বাড়িতে না নিয়ে নদীর কাছে খামার বাড়িতে নেয়া হয়েছিলো। শিকদার চৌধুরী নয়নকে দেখে বললেন এসো এসো বাবা একটু হলেই বড় সর্বনাশ হয়ে যেত ভাগ্যিস আমার মাঝিগুলো ছিল। নয়নের মাও এগিয়ে গেল উৎকণ্ঠা নিয়ে ভাইয়ের খোঁজে। তিনি দেখলেন একটা মেয়ে তার কোলে নিয়ে তার প্রৌঢ় ভাইয়ের যতœ করছে। সে তার এতো বয়সের জীবনে এতো মনোরম, অপূর্ব আর স্নেহবৎসল মেয়ে দেখেনি যে পরম যতেœ তার ভাইয়ের সেবা করছে। এতোটুকুন মেয়ের এতো দায়িত্বপরায়ণতা দেখে তার দুইচোখ উথলে উঠল। তার ভাই কাঁদোকাঁদো চোখে বলল বুবু এই মেয়ে আমাকে নিজের মেয়ের মতো সেবা করে বাঁচিয়েছে। নয়নের মা বলল হাজার বছর বাঁচো মা। মেয়েটির মাথায় আদর দিয়ে বললেন, তোমার নাম কী মা? একটি মধুর, কচি, কন্ঠ চারদিক মিষ্টতায় ভাসিয়ে নয়নের মায়ের দু’কানে মধুর মতো বেজে উঠলো, ‘সুচরিতা’।