ইতিহাস – ঐতিহ্য পর্যবেক্ষণে সরকারি মীর ইসমাইল হোসেন কলেজের শিক্ষা সফর

ইতিহাস – ঐতিহ্য পর্যবেক্ষণে সরকারি মীর ইসমাইল হোসেন কলেজের শিক্ষা সফর

এ.এস.লিমন:
কুড়িগ্রামের রাজারহাটে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্যেই রয়েছে শিক্ষার সম্পূর্ণতা। সম্প্রতি শিক্ষা সফরের আয়োজন করে সরকারি মীর ইসমাইল হোসেন কলেজ।২৮ জানুয়ারী সোমবার নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর এলাকায় দিনব্যাপী এ আয়োজন উপভোগ করেন শতাধিক শিক্ষার্থী

হালকা কুয়াশা পড়া সকালে সবাই এসে উপস্থিত কলেজ ক্যাম্পাসে। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৭টায় যেন থেমে আছে। ধীরে ধীরে মোটামুটি সবার আসা নিশ্চিত হওয়ার পর সরকারি মীর ইসমাইল হোসেন কলেজ থেকে সকাল ৯ টায় যাত্রা শুরু হয় নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরের উদ্দেশে। শতাধিক শিক্ষার্থীসহ ছয়টি বাস গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে। কারো চোখে হয়তো তখনো ঘুম লেগে আছে, কিন্তু বাসে ওঠার পর হইচই আর আনন্দে সেই ঘুম উধাও হয়ে গেল। আর সবকিছুর সঙ্গে গান তো রয়েছেই। সবাই যার যার জায়গা বেছে নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবকরা সবার হাতে সকালের নাশতা পৌঁছে দিলেন। বাস চলছে সেই সঙ্গে চলছে গল্প, আনন্দ আর গান। কেউবা বাসের ভেতরেই ছবি তোলায় ব্যস্ত। ততক্ষণে গাড়িটি রংপুর পেরিয়ে গিয়েছে। হালকা ঠাণ্ডা আবহাওয়া যেন সায় দিচ্ছে শিক্ষা সফরের আনন্দকে।

তবে সব আনন্দের মধ্যেও নিজের অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করার পরিকল্পনা চলছিল সবার মনেই। কেননা শিক্ষা সফরের আগেই প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল।ঘড়ির কাঁটা বেলা ১টা ছুঁই ছুঁই করছে, তখন মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে প্রবেশ করবে বাস। ঘোষণা শোনামাত্রই সবাই একসঙ্গে আনন্দধ্বনি করে উঠল। বাস এসে থামল পাহাড়পুরের।

একে একে তারা প্রবেশ করল পাহাড়পুরে ভেতর। সেখানে জমায়েত হওয়ার পর উপস্থিত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দিলেন কীভাবে ছবি, ভিডিও ফুটেজ, তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হবে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা নিজেদের কাজ শুরু করলেন। ঐতিহাসিক এ স্থানটির বিহারগুলো অপূর্ব কারুকাজে সমৃদ্ধ। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা মহা বিহার বর্তমানে ধবংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করেছিলেন। পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে।একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় পাহাড়পুরের।

আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এটি তিনশত বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল।শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয় চীন, তিব্বত, মায়ানমার , মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা এবং ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন।

বিহারের অন্তর্বর্তী স্থানের উন্মুক্ত চত্বরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ। এখন এটি ২১মি উঁচু হলেও মূল মন্দিরটি কমপক্ষে ৩০ মি উঁচু ছিল। তিনটি ক্রমহ্রাসমান ধাপে ঊর্ধ্বগামী এ মন্দিরের ভূমি পরিকল্পনা ক্রুশাকার। প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১০৮.৩ মি ও ৯৫.৪৫মি। কুশের মধ্যবর্তী স্থানে আরও কয়েকটি অতিরিক্ত দেয়াল কৌণিকভাবে যুক্ত। মূল পরিকল্পনাটির কেন্দ্রে দরজা জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ আছে।

অঙ্গনের দক্ষিণ ও পূর্বাংশে ভোজনশালা এবং রন্ধনশালা অবস্থিত। এই দুটি স্থাপনার মাঝে ৪৬মি দীর্ঘ ইট বাঁধানো একটি নর্দমা আছে এবং এর কাছে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে। তাছাড়াও রয়েছে কিছু নিবেদন স্তূপ, প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি ইত্যাদি।নিবেদন স্তূপগুলোর মাঝে দক্ষিণ ও পূর্বাংশে অবস্থিত স্তূপটি ১৬কোণ বিশিষ্ট নক্ষত্র আকৃতির।বিহারের দক্ষিণ দেয়াল হতে ২৭মি দক্ষিণে অবস্থিত একটি মঞ্চে অনেকগুলো স্নানাগার এবং শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছিলো। মঞ্চটি পূর্ব ও পশ্চিমে ৩২মি দীর্ঘ এবং উত্তর ও দক্ষিণে ৮.২৩মি প্রশস্ত। এটি বিহারের ১০২ নম্বর কক্ষ থেকে একটি উঁচু বাধানো পথ দ্বারা সংযুক্ত। এই পথের নিচে বিহার দেয়ালের সমান্তরালে ১.৯২মি চওড়া এবং ২.৫মি উঁচু একটি ভল্টযুক্ত খিলান রয়েছে।বিহারের দক্ষিণ ও পূর্ব কোণ থেকে প্রায় ৪৯মি দক্ষিণে প্রায় ৩.৫মি প্রশস্ত স্নানঘাট অবস্থিত। পশ্চিমের উদগত একটি দেয়ালের ১.৪মি পূজার ঘর সহ আরোও কতকি?

ঘুরে দেখতে দেখতে কখন যে দুপুর হয়েছে কেউ টের পায়নি। তবে পেটের ক্ষুধা জানান দিচ্ছে সময় হয়েছে।পাহাড়পুরের সামনে খোলা মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে সবাই দুপুরের আহার পর্ব সেরে নিল। এর পর শুরু হলো আনন্দ আয়োজন। গান, কুইজ, লাকি কুপন ইত্যাদি হালকা বিনোদন শেষ হলো শিক্ষকদের বক্তব্য দিয়ে। এবার ফেরার পালা, দলবেঁধে আবার সবাই বাসে চেপে বসল। কিন্তু সবাই খানিকটা বিষণ্ন। সারা দিনের ক্লান্তি যতটা না জেঁকে বসেছে, তার চেয়ে বেশি গ্রাস করেছে ফেরার দুঃখবোধ। তবে প্রতি বছরই এমন আয়োজন যেহেতু হবে, তাই ম্লান হওয়া আনন্দের কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে সবার মধ্যেই।

সংগৃহিত