কুড়িগ্রামের জেলে মাঝিদের জীবন চরম সংকটে কাটছে-রাজারহাট বিডি

কুড়িগ্রামের জেলে মাঝিদের জীবন চরম সংকটে কাটছে-রাজারহাট বিডি

এজি লাভলু:

কুড়িগ্রাম সদরের ধরলা নদীর পাড়ে মাছ ধরছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আবু বক্কর সিদ্দিক। তিন সন্তাানের জনক পেশায় জেলে এ মানুষটির বাড়ি উপজেলার ভোগডাঙ্গার কৈয়াপাড়া গ্রামে।

ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে মাছ ধরে কেটেছে তার পুরো জীবন। পরিচয় ঘটেছে নদীভাঙনে ভিটে হারানোর মতো অভিজ্ঞতার সঙ্গেও। তবে তাতে তিনি দমে যাননি।

নদীর বুকে জাল ফেলে নতুন উদ্যমে শুরু করেছেন বাঁচার লড়াই। তবে বর্তমানে খোদ প্রকৃতিই যেন আর তাকে সহায়তা করছে না। যে নদীকে কেন্দ্র করে তার জীবনের চাকা ঘুরছিল, সেই নদীই আজ মৃতপ্রায়। বর্ষায় কমবেশি পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে বের হয়ে আসছে তলদেশ, জাগছে চর।

যা মারাত্মক প্রভাব ফেলছে তার জীবন-জীবিকায়। পানি কমে যাওয়ায় সারা রাত মাছ ধরে এখন তিনি বড়জোর আয় করতে পারছেন দেড়শ টাকা।

আর এ দিয়ে সংসার পরিচালনা যে কতটা দুরূহ তা তার কপালের ভাঁজেই স্পষ্ট। কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমার, জিঞ্জিরাম, জালছিড়া, সোনাভরি, হলহলিয়া, গঙ্গাধরসহ বয়ে গেছে ১৬টি নদ-নদী। এর মধ্যে প্রধান চার নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারের দৈর্ঘ্য ১৬২ কিলোমিটার।

আর এগুলোর অববাহিকায় বসবাসকারী আবু বক্কর সিদ্দিকের মতো জেলের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার। উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন এ মানুষগুলোর একসময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহে খুব একটা সমস্যা হতো না।

তবে সংকট দেখা দিয়েছে একে একে নদ-নদীর নাব্য হারানোর পর থেকেই। বর্ষা মৌসুমে এখনো তারা মাছ ধরে যাচ্ছেন। কিন্তু শুষ্ক মৌসুম এলেই বাধ্য হয়ে গ্রহণ করতে হচ্ছে অন্য পেশা।

পরিস্থিতি দিন দিন এতটাই সঙ্গিন হয়ে উঠেছে যে তারা চাইছেন না পরবর্তী প্রজন্ম আর এ পেশায় থাকুক। সরেজমিন দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের সামান্য পানি জেগে ওঠা চরের ফাঁক গলে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে।

আর ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারে পানির আধার সরু নালার মতো। আর এ সামান্য পানিতেই জেলেরা যেন দৈবের মুখ চেয়ে মাছ ধরে চলছেন। কথা হলে ধরলা সেতুর কাছে কয়েকজন জেলে জানান, তারা এখানে ১০-১২ জন জেলে প্রতিদিন নৌকায় করে মাছ ধরেন।

একটি নৌকায় জেলে থাকেন দুজন করে। বর্তমানে সারা রাত মাছ ধরে নৌকাপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকার বেশি আয় হয় না। কখনো কখনো আয় হয় আরো কম। তাছাড়া এক একটি মাছ ধরার ছোট নৌকা তৈরিতে কমপক্ষে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি তিন বছর পর পর নৌকা পাল্টাতে হয়।

তার ওপর আছে জাল বোনার সুতার খরচ। ফলে এত কম আয়ে তাদের আর চলছে না। শুধু জেলেরাই নয়, একইভাবে পেশা সংকটে পড়েছেন জেলার অন্তত দুই হাজার মাঝি। পানি না থাকায় অনেকেই আর আগের মতো নৌপথে যাতায়াত বা পণ্য পরিবহন করছেন না।

তাছাড়া এত সামান্য পানিতে নৌকা চালানোও সম্ভব না। এ অবস্থায় জেলেরা যদিও বা কিছু মাছ পাচ্ছেন, মাঝিদের নৌকা থেমে আছে একেবারেই। সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের মাঝি আবুল হোসেন জানান, এখন নৌকা চলে না, তাই বেকার বসে আছি। মাঝেমধ্যে অন্য কাজ জোটে।

কিন্তু এ সময়ে অন্যের জমিতে ধানের চারা রোপণ করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের চর বড়াইবাড়ী গ্রামের আরেক মাঝি এজাজুল হক জানান, শুকনো মৌসুম এখন আমাদের মতো মানুষের জন্য অভিশাপ। কারণ, কাজের অভাবে এ সময় নির্ভর করতে হয় ধারদেনার ওপর।

যা পরে পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। কুড়িগ্রাম জেলা ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমার, জিঞ্জিরাম, জালছিড়া, সোনাভরি, হলহলিয়া, গঙ্গাধরসহ ১৬টি নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে। এ অবস্থায় নদীনির্ভর এসব মানুষের দাবি, দ্রত ড্রেজিংয়ের মধ্য দিয়ে জেলার নদ-নদীগুলোয় প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হোক। যাতে তারা অন্তত নিজ নিজ পেশা অবলম্বন করেই জীবিকা নির্বাহে সমর্থ হন।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা ও দুধকুমারের খননের জন্য প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। প্রস্তাব তৈরির কাজ শেষ হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হবে। আর ধরলা নদী খননের কাজ করবে বিআইডব্লিউটিএ। ব্রহ্মপুত্র নদের বিষয়টি আমার জানা নেই।

জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, চিলমারী নৌবন্দরের কার্যাক্রম চালু করার কাজ চলছে। আর নৌ-বন্দর চালু হলে চ্যানেলগুলোয় নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য খননসহ অন্য সব কাজ করা হবে। এতে নদ-নদীগুলোয় স্বাভাবিক জলধারা ফিরে আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।