বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস

মো. সাহেব আলী:
“যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরি-যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”

আজ ১৭ই মার্চ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস। এদিনে বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশকে পথ দেখানোর জন্য বাংলার আকাশে এক ধ্রুবতারার আবির্ভাব হয়েছিলো। যার দেখানো পথ ধরেই পরাধীন বাঙালি হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে আপন করে পেয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধু, বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের মাধ্যমে এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসাবে। মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিতপূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে।’

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন দম্পতির তৃতীয় সন্তান। ডাক নাম খোকা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সকলের আদরের ধন। শৈশব থেকেই খোকা ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির। ভাল ফুটবল খেলতেন। টুঙ্গিপাড়া গ্রাম, ফসলি মাঠ, গাছপালা, প্রকৃতি, নদীর সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো নিবিড়ভাবে। নিখাঁদ ভালোবাসা নিয়ে তিনি প্রকৃতি ও মানুষের সাথে অবলীলায় মিশে যেতেন। গরিব সহপাঠীদেরকে বই-খাতা, জামা-কাপড় দিয়ে সাহায্য করতেন। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে এমন উদারতা, মানবিকতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় সাত বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এ স্কুলে লেখাপড়া করার পর চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালে তাঁর দুটি চোখে অপারেশান করা হয়। এ জন্য সাময়িকভাবে কিছুকাল পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। ১৯৩৭ সালে তিনি আবার লেখাপড়া শুরু করেন। এবার নতুন ঠিকানা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল। এ স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং ১৯৪৬ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে তাঁদের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্কুল জীবন থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন। তার কৈশোর রাজনীতির দীক্ষাগুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এজন্য মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁকে কারাবাস বরণ করতে হয়। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম কাতারের রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন এবং ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কলেজ জীবনেই বঙ্গবন্ধু এ উপমহাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক ধারায় স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছু সময় পর পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিমাতাসূলভ আচরণে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন বাঙালি প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করেনি। বিকলাঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের হাতবদল হয়েছে মাত্র। এ উপলব্ধি নিয়ে বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে অগ্রসর হন। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক এবং শোষণমুক্ত দেশ গঠনের প্রত্যয়ে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নিজেকে উৎসর্গ করেন। পাকিস্তানী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে সংঘটিত প্রতিটি আন্দোলনেই তিনি সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ৫৮ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ৭০ সালের নির্বাচন এবং ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ; এককথায় বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রত্যেকটি ধাপে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও অসীম সাহস নিয়ে পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রাম করে গিয়েছেন। এভাবে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির অগ্রদূত। এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে ’৬৯ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে প্রায় দশ লক্ষ ছাত্র-জনতার সমাবেশে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধীতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। চূড়ান্ত পর্বে যা রূপ নেয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। ৭১ এর মার্চ মাস জুড়ে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের কালরাত্রি। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসযোগে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি বাংলার মাটি থেকে শেষ হানাদারটিকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। এর পরপরই বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম এবং তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

বঙ্গবন্ধু শিশুদেরকে মনেপ্রাণে ভালবাসতেন। তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে পালন করা হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। বিগত কয়েক বছর থেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন, গণমাধ্যম যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে আসছে। এ উপলক্ষে শিশু সমাবেশ, শোভাযাত্রা, রচনা প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ফলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও ,শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে’। তিনি আরও বলতেন, আমাদের নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটাকে ভালো করে গড়তে হলে এই শিশুদেরকে সঠিকভাবে গড়তে হবে। ওদের তাজা রক্তে দেশপ্রেম ঢুকাতে হবে। ওদের ভালোমতো গড়তে পারলেই আমি স্বার্থক।

শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বঙ্গবন্ধু নানা পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি নিজ হাতে গ্রহণ করেছিলেন।
শিশুদের প্রায় সকল অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যেত। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেষবারের মতো নিজের জন্মদিন পালন করেন শিশুদেরকে সাথে নিয়ে। নতুন গণভবনে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে বয়স্কাউট, গার্লসগাইড, কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর আসরের প্রায় ৮০০ জন ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে। সবার পরনে নিজ নিজ সংগঠনের ইউনিফর্ম। গণভবনের সবুজ চত্বরে বর্ণিল রঙয়ের মেলায় বঙ্গবন্ধু সেদিন তাদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন কোনোরকম প্রোটোকল ছাড়াই ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির জীবনে শোকাবহ দিন। সেনাবাহিনীর বিপথগামী একদল সদস্যের দ্বারা নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। ঘাতকের বুলেট প্রাণ কেড়ে নিলেও তাঁর আদর্শকে বাংলার মাটি থেকে মুছে ফেলতে পারে নি। বরং দিনে দিনে তা মহীরূহতে পরিণত হয়েছে। যতদিন বাঙালি থাকবে, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন এই বাংলার জল, হাওয়া, আর ধুলিকণায়। বেঁচে থাকবেন লাল সবুজের পতাকায়, বেঁচে থাকবেন আমার সোনার বাংলা ধ্বনিতে।

স্বাধীনতার মহানায়কের জন্মদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

তথ্যঋণ:

o অসমাপ্ত আত্মজীবনী, লেখক: শেখ মুজিবুর রহমান
o কারাগারের রোজনামচা, লেখক: শেখ মুজিবুর রহমান
o উইকিপিডিয়া
o বাংলাপিডিয়া
o পত্র-পত্রিকা
o ইন্টারনেট