বিধিবহির্ভূত স্লোগান “নো বিসিএস নো ক্যাডার”
বিসিএস পরীক্ষা কোন সনদের পরীক্ষা নয়, তাই যোগ্যতার মানদণ্ড বিচারের জন্য বিসিএস পরীক্ষাও নয়। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক সরকারি চাকরির জন্য একটি বাছাইকরণ প্রক্রিয়া। জনবহুল এই বাংলাদেশে লাখ লাখ মেধাবী উচ্চশিক্ষার সনদধারী এখনো চাকরির সন্ধানে ঘুরছেন। প্রতি বছর এর সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের পক্ষের কখনোই সম্ভব নয় সবার জন্য সরকারি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। শিক্ষা ক্ষেত্রেও দেখা যায় পদ সল্পতার কারণে লাখ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র কয়েকশ প্রার্থীকে চূড়ান্ত বাছাই পর্বে টেকানো হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কোটাও বিরাজমান। যারা বাদ পড়েন তাদের মধ্যে অনেকেই প্রিলি, রিটেন পাশ করেন কিন্তু ভাইভা থেকে বাদ পড়েন, আবার অনেকে বাদ পড়ার জন্য অদৃশ্য কোন লেনদেনকে দায়ী করেন, অবশ্যই তার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। পদ স্বল্পতার কারণে লাখ লাখ আবেদনকারী, যারা বাদ পড়েছেন তারা অযোগ্য বলে প্রমাণিত হতে পারেনা এবং অযোগ্যতার কোন সনদও তাদের ইস্যু করা হয়নি। আর যাদের টেকানো হয়েছে চাকরির নিয়োগপত্র ছাড়া যোগ্যতার বাড়তি কোন সনদ তাদের সরকার দেয়নি। সরকারের শূন্যপদ যত বেশি থাকতো সরকার এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তত বেশি ক্যাডার করে নিত। সুতরাং বিসিএস পরীক্ষা শিক্ষকদের জন্য যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড হতে পারেনা। মূল মানদণ্ড হল বিসিএস নামক এই বাছাইকরণ প্রক্রিয়ায় আবেদন করার জন্য চাহিত যোগ্যতা/সনদ আছে কি না। বিসিএস ও জাতীয়করণ ভিন্ন ২টি পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিতে পদায়নের ভিন্ন ২টি প্রক্রিয়া ছাড়া অন্যকিছু হতে পারেনা।
অনেক বিসিএসকৃত শিক্ষকদের দেখেছি শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীর সামনে সঠিকভাবে নিজকে মেলে ধরতে পারছেন না। অফুরন্ত মেধার প্রাপ্তি ও প্রদানের কেন্দ্রবিন্দুতে দুর্বল এক রাউটারের মত অকেজো হয়ে থাকছেন। আর অনেক বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষক আছেন শিক্ষকতা পেশাকে চ্যালেঞ্জিং হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এবং শ্রেণিকক্ষে অবলীলায় শিক্ষার্থীদের মন জয় করে পাঠদান কার্যক্রমের মাধ্যেমে তাদের অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক বিলিয়ে যাচ্ছেন। ঐসব শিক্ষাক স্বভাব শিক্ষক, তারা স্বীয় জ্ঞানের পরিধিকে প্রতিনিয়ত আপডেট করে বাডিয়ে তুলছেন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রিয় শিক্ষকের তালিকায় শীর্ষে আছেন। তাই যোগ্যতার সনদ হল বিষয়ভিত্তিক সনদ ও কর্মক্ষেত্রে কাজের প্রতি নিষ্ঠা, অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতা।
সম্প্রতি স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী, একই কাজের জন্য ভিন্ন বেতন চলবে না- এই মর্মে রায় দিয়েছে ভারতের উচ্চ আদালত। এই রায় অত্যন্ত যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। তাহলে একই ধরনের কলেজে একই বিষয়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন ভিন্ন ভিন্ন কী করে হয়? কাজের ফলাফল যদি সমান হয়, শিক্ষার্থীদের অর্জিত সার্টিফিকেটের মান যদি সমান হয় তবে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা সমান হবেনা কেন? তাই সরকার ঐ সকল সমজাতীয় পদে পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে, হোক বিসিএস প্রক্রিয়ায় অথবা জাতীয়করণ প্রক্রিয়ায় পদায়ন করলে তারা সবাই একই সুবিধা ও মর্যাদা পাওয়ার আইনত অধিকার রাখেন। যা আদালতের রায়ের মাধ্যমেও স্বীকৃত। বিগত বছরগুলোতেও অধিকার ও যৌক্তিকতা বিচারে বাংলাদেশ সরকার জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের সরকারি সকল সুবিধা ও মর্যাদা বিসিএস শিক্ষকদের সমপরিমাণে প্রদান করছে।
জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের সরকারি সুবিধা প্রদান করতে গিয়ে বিসিএস শিক্ষকদের কোন সুবিধা কর্তন করা হয়েছে অথবা তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগপ্রপ্ত হয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে পাঠদান করে আসছেন তারা পেশাগত করণে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষানবিশ বিসিএস ক্যাড়ারদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ও মেধা অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে সবাই উচ্চশিক্ষার সনদধারী এবং বিসিএস এর জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা তাদের আছে। কাজেই জাতীয়করণ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে এইসব শিক্ষকদের ক্যাড়ার সুবিধা দিলে বিসিএস প্রক্রিয়ায় আসা ক্যাড়ারদের কিভাবে সম্মানহানী হয়? তাঁদের প্রতি কিভাবে অন্যায় করা হয়? তারা কিভাবে সরকারকর্তৃক প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তারা বরং নো বিসিএস নো ক্যাড়ার স্লোগানের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জাতীয় স্বার্থে বৈষম্যের পদচিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন। এই বৈষম্য আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় কখনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারবেনা। একই ডিপার্টমেন্টে অভিজ্ঞ কোন শিক্ষকের ছাত্র জাতীয়করণের পর সদ্য বিসিএস এর মাধ্যমে ঐ ডিপার্টমেন্টে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে ক্যাড়ার ও নন ক্যাড়ার বৈষম্যের কারনে স্বীয় শিক্ষকের চেয়ে তাঁর ছাত্র যদি অধিক মর্যাদা লাভ করেন তাহলে নন ক্যাড়ার বা অভিজ্ঞ শিক্ষকটির জন্য একই কর্মক্ষেত্রে একটি অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করবে। সেটাই বরং অমানবিক বা অন্যায়। সেটা উচ্চ আদালত বুঝতে পারলেও স্বার্থান্বেষী মহল স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার মোহে বুঝতে চায়না।
আত্তীকরণ বিধিতে যাই বলা থাকুন না কেন মানুষের জন্যই বিধি, বিধির জন্য মানুষ নয় এবং মানুষই বিধির প্রণেতা। তাই সকলের কথা বিবেচনায় বিধির পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জিতকরণ বিধি প্রণেতারাই করবেন। তাই যে বা যারা নিজেদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিধিবহির্ভূত স্লোগান “নো বিসিএস নো ক্যাডার” দিচ্ছেন, এই স্লোগান সুষম শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপন্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্যের দেয়াল সৃষ্টি ছাড়া কিছুই হতে পারে না। আইনপ্রণেতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্লামেন্ট, দেশের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী হতে পারেনা। স্বাধীনতার আগেও এই দেশের মানুষের সব চেয়ে বড় বৈষম্যের বিষয় ছিল শ্রম বৈষম্য। মানুষ শুধু খেটেছিল, না পেয়েছিল মর্যাদা, না পেয়েছিল ন্যায্য পাওনা। আজ স্বধীনতার এত বছর পরও আমরা কেন সে শ্রম বৈষম্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবোনা? আমাদের পারতে হবে একটি শক্তিশালী রাষ্ট গঠনের জন্য। আমাদের পারতে হবে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে একটি বৈষম্যহীন আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা গঠনের জন্য। যে ব্যবস্থায় সুনাগরিক গড়ার লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কথা ভাবতে হবে।
বর্তমান সরকার স্বাধীনতার পক্ষের সরকার, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদের সরকার, বর্তমান সরকার স্বপ্নের পদ্মা সেতু গড়ার কারিগর, বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের এক শক্তিশালী সরকার। “নো বিসিএস নো ক্যাডার” এই স্লোগানের কণ্ঠরোধ করে একই প্রতিষ্ঠানে একই শ্রেণিতে কর্মরত সকল শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা এই সরকারের পক্ষেই সম্ভব এবং এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মোঃ আলাউদ্দিন
সহ সাধারণ সম্পাদক
অনার্স মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদ (কেন্দ্রীয় কমিটি)