দেখার কেউ নেই রাজারহাটে দলিল লেখক সমিতির নামে যা হচ্ছে …

দেখার কেউ নেই রাজারহাটে দলিল লেখক সমিতির নামে যা হচ্ছে …

তৌহিদুর রহমান:
কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সাবরেজিস্ট্রার অফিসে দলিল লেখক সমিতি কর্তৃক কাউন্টার ফি আদায় করছে প্রকাশ্যে। সাবরেজিস্ট্রার ও দলিল লেখকদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেন ভুক্তভোগিরা। মনে হচ্ছে যেন এসব দেখার কেউ নেই।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে দলিল লেখক সমিতির কয়েকজন নেতার যোগসাজসে রশিদ ছাড়া দলিল প্রতি কাউন্টার ফির নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। দলিল রেজিস্ট্রারীর নীতিমালা না মেনে অনেক সময় ভূয়া কাগজপত্র বানিয়ে জমি রেজিস্ট্রি কার্যক্রম চলছে। এছাড়াও ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি ফি জমা দেয়ার পরেও অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে, যার কোন রশিদ বা ভাউচার দেয়া হয়না। এমনকি চাইলেও কোন প্রমাণপত্র পাওয়া যায়না। প্রতিবাদ করলে উল্টো দলিল লেখকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়।

সূত্রে জানা যায়, ৬০০০ টাকা মূল্য হতে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দলিল হলে এর কাউন্টার ফি গুণতে হয় ৬০০০ টাকা, ১ লাখ ১০ হাজার হতে ৩ লাখ পর্যন্ত হলে কাউন্টার ফি ৭০০০ টাকা, ৩ লাখ ১০ হাজার হতে ৫ লাখ পর্যন্ত হলে কাউন্টার ফি গুণতে হয় ৭৫০০ টাকা, ৫ লাখ ১০ হাজার হতে ৮ লাখ পর্যন্ত হলে কাউন্টার ফি গুণতে হয় ৮৫০০ টাকা, ৮ লাখ ১০ হাজার হতে ১০ লাখ পর্যন্ত কাউন্টার ফি গুণতে হয় ৯৫০০ টাকা এবং ১০ লাখ হতে উপরে যত হবে তার কাউন্টার ফি গুণতে হবে ১০ হাজার টাকা। অপরদিকে হেবার ঘোষণা, দানের ঘোষণা ও অছিয়ত উইল বন্টনে ১ শতাংশ হইতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত দলিল লেখক সমিতিকে দিতে হয় ৫৫০০ টাকা। সাড়ে ১০ শতাংশ হইতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত গুণতে হয় ৬০০০ টাকা, সাড়ে ২০ শতাংশ হইতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত গুণতে ৬৫০০ টাকা, সাড়ে ৫০ শতাংশ হইতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত গুণতে হয় ৮০০০ টাকা। ১০০ শতাংশ হতে কাউন্টার ফি ৯০০০ টাকা। পাওয়ার মর্টগেজ ও রিডেশন দলিলের কাউন্টার ফি বাবদ আদায় ৬০০০ টাকা। মসজিদ-মন্দির, কবর স্থান, শ্মশান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দলিল প্রতি কাউন্টার ফি গুণতে হয় ১৫০০ টাকা এবং রেজিস্ট্রি অফিসের জমির দলিল হওয়ার পর টিপসহি বাবদ মসজিদের নামে ৫০ টাকা আদায় করা হলেও মসজিদে দেয়া হয় ২০ টাকা।

শপথ নামা নামে দলিল প্রতি ১০০০ টাকা আদায় করা হয়। পাশাপাশি দলিল লেখকরা অভিনব কৌশল করে সরকারি ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে দোলাকে ডাঙ্গা বানানো হয়, অনেক সময় ডাঙ্গাকে ডোবা বানানো হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জমি ক্রেতারা বলেন, সবকিছু ঠিক থাকলেও নাকি দলিল প্রতি সাবরেজিস্ট্রারকে ১৩০০ টাকা কাউন্টার হতে সম্পাদকের মাধ্যমে অফিসে প্রদান করেন। যা যেকোন সময়ে কপিষ্ট পলাশের মাধ্যমে গোপনে সাব-রেজিস্ট্রারকে প্রদান করা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন দলিল সমস্যা দেখিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার ১০০০ থেকে ৫০০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত পলাশের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকেন। অথচ সরকারিভাবে প্রতি লাখ টাকার দলিল মূল্যে ৯% হারে সরকারি কোষাগারে ৯০০০ টাকা ব্যাংকে জমা প্রদান করা হয়। আর কাউন্টার ফির নামে যে টাকা নেয়া হচ্ছে তার কোন রশিদ/রিসিভ তারা দেননা। রাজারহাট সাবরেজিস্ট্রার নুসরত জাহান-এর নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমিতো সরকারি তালিকা ঝুলিয়ে দিয়েছি, আর দলিল লেখক সমিতি কাউন্টার ফির নামে কি করছে ওইসব আমি জানিনা, কারণ তারা আমার অফিসের বাহিরে কি করছে, সেটা আমার দেখার বিষয় না। সাবরেজিস্ট্রারের নিকট প্রতি বছর কি পরিমাণ দলিল হয় তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমপক্ষে ৪ হাজার। তবে মনে হচ্ছে এবারে কিছু কম হবে। এ হিসাব মতে বছরে গড় প্রতি দলিল ৬০০০ টাকা কাউন্টার ফি ধরলে দলিল লেখক সমিতি প্রতি বছর শুধুমাত্র রেজিস্ট্রি দলিলে আদায় করেন ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, টিপসহি বাবদ ৪ হাজার দলিলে দলিল প্রতি ৫০ টাকা হারে মসজিদের নামে উত্তোলন করে ২ লাখ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনৈক এক দলিল লেখক এ প্রতিনিধিকে বলেন, প্রতি বছর সবকিছু মিলিয়ে দলিল লেখক সমিতির কাউন্টার ফিতে প্রায় ৩ কোটি টাকার মত জমা হয়। বর্তমান রাজারহাট দলিল লেখক সমিতির সদস্য সংখ্যা ৬২ জন। প্রতি মাসে কাউন্টার ফির জমাকৃত অর্থ ৪টি গ্রেডে-গ্রেড অনুযায়ী দলিল লেখকদের মাঝে বন্টন করা হয়ে থাকে। ‘এ’ গ্রেডে রয়েছে সভাপতি-সম্পাদকসহ কমিটির নেতৃবৃন্দ প্রায় ১২-১৪ জন, তাদের প্রতি মাসে কাউন্টার ফি হতে বন্টনকৃত অর্থ পান সর্বোচ্চ ২৫০০০ এবং সর্বনিম্ন ১৬০০০ টাকা। ‘বি’ গ্রেডে যারা রয়েছেন তারা পান সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ও সর্বনিম্ন ৮ হাজার, ‘সি’ গ্রেডে যারা রয়েছেন তারা পান সর্বোচ্চ ৫১০০ এবং সর্বনিম্ন ৪১০০ টাকা, ‘ডি’ গ্রেডে যারা রয়েছে তারা পান সর্বোচ্চ ৩০০০ এবং সর্বনিম্ন ২৫০০ টাকা। জনৈক ওই দলিল লেখক ‘সি’ গ্রেডে রয়েছেন তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, পূর্বে পেতাম ৫১০০ টাকা করে বর্তমান আমাদেরকে দেয়া হচ্ছে ৪১০০ করে টাকা।

তিনি আরও বলেন, সভাপতি-সম্পাদক প্রতি মাসে আপদকালীন ফান্ড হিসাবে ৫০ হাজার টাকা করে সমিতির ফান্ডে জমা রাখেন। যার কোন হিসাব-নিকাশ তারা আমাদেরকে দেননা। দলিল লেখক সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের নিকট আমরা জানতে চাইলে তারা বলেন, বর্তমান নাকি খরচাপাতি বেড়েছে, তাই জনপ্রতি ১০০০ করে টাকা কম দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে দলিল লেখকরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ষ্ট্যাম্প লেখা ফি পেয়ে থাকেন। রাজারহাট দলিল লেখক সমিতির সভাপতি আব্দুল হামিদ ও সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম সাজু দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দলিল লেখক সমিতি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, সাংবাদিকরা তথ্য নিতে গেলেও তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

গত ১১ জুলাই রাজারহাট উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় প্রেসক্লাব রাজারহাট-এর সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম- রাজারহাট দলিল লেখক সমিতির কাউন্টার ফি কি ! এ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করলে সভার সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহ: রাশেদুল হক প্রধান বলেন, আপনারা তাদের অনিয়মের বিষয়গুলো নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন, তারপর বিষয়টি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অবহিত করবো। দলিল লেখক সমিতির কাউন্টার ফি বলতে ষ্ট্রাম,দলিল কম্পিউটার,হলফনামা,অফিসের হাতে ফি ও সাব-রেজিষ্ট্রারের ১৩০০ টাকা। বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্বেও দাতা-গ্রহীতাদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগিরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট অনেক সময় শরনাপন্ন হন।

এ বিষয়ে রাজারহাট সাবরেজিষ্ট্রার নুসরত জাহানের সঙ্গে একাধিকবার তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।